কুমিল্লাতে বেড়াতে গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। অনেকদিন থেকেই রূপবান মুড়া ,কোটিলা মুড়া করে করে পাগল করে ফেলতেছিলাম সবাইকে। এরকম বেশ কয়েকটা যে মুড়া কুমিল্লাতে আছে এই জিনিসটাই শুধু আমি জানি কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না। কুমিল্লার মানুষ উঁচু জায়গাকে মুড়া বলেন বলেই এমন নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
কুমিল্লাতে আমার মাঝে মাঝেই যাওয়া হলেও এইসব জায়গাতে কখনোই যাওয়া হয় নাই আমার। এবার আমাদের সাথে আমার বড়ো ভাবিও ছিল। সে আমার সাথে যোগ দেয়ার কারণেই বলা যাই যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। না হলে প্রতিবারের মতো এবারও পরেরবার যাবো বলে আমাকে সান্তনা দিয়ে বাসায় ফেরত নিয়ে আসতো সবাই মিলে।
কুমিল্লা বার্ডের কাছাকাছিই এই রূপবান মুড়া অবস্থিত। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি ) এর মাঝখানে একটা পাহাড়ের উপর এই স্তূপ অবস্থিত।
স্থানীয় লোকজনের মাঝে অবশ্য প্রচলিত রয়েছে যে এখানেই বাংলার লোককাহিনীর রহিম -রূপবান গল্পের নায়ক নায়িকারা বাস করেছেন। আর সেখান থেকেই এই জায়গার নাম রূপবান মুড়া। অবশ্য এই বৌদ্ধ বিহারটি ছাড়াও রূপবানের নামের সাথে জড়িত রূপবান কন্যার বিহার ও রূপবাণী মুড়া নামের আরো দুইটা প্রত্ন স্থাপনা রয়েছে। পবর্তীকালে হয়তো সেসব জায়গা খননের মাধ্যমে উঠে আসবে আমাদের হারিয়ে যাওয়া অতীতের অনেক গৌরব গাঁথা।
আমাদের এই বিহারটি খুঁজে পেতে কিছুটা সমস্যাই হয়েছিল। এর কারণ এই বিহারটি শালবন বিহারের মতো অত জনপ্রিয় পর্যটক কেন্দ্র হয়ে উঠে নাই। জিজ্ঞেস করতে করতে আমরা এই জায়গাতে গিয়ে পৌঁছাই। এই পাহাড়ের নিচে রাস্তার পাশেই দেখলাম আরো খনন কাজ চলতেছে।
এক বিজিবি সদস্য আমাদেরকে এই বিহারে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেন। বেশ খানিকটা ঢালু জায়গা বেয়ে উপরে উঠতে হয় । টিকেট কেটে ভেতরে যেতে হয়। তবে ভেতরে ঢুকার আগেই আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।
আসলে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর প্রতি আমার একটা দুর্বলতা কাজ করে। পাহাড়ের উপরে একদম সমতল একটা জায়গাতে বিহারটি দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমরা গিয়েছিলাম একদম দুপুরবেলাতে আর সেদিন প্রচন্ড রকমের গরম ছিল যা কারণে খুব বেশি সময় আমরা সেখানে কাটাতে পারি নাই। একদম অল্প সময় পরেই আমরা নিচে নেমে আসি রোদ আর গরমের কারণে।
এখানে যেতে হলে আসলে শীতের সময়ে কিংবা বিকেল বেলা হবে শ্রেষ্ঠ সময়। এই জায়গা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা না থাকার কারণে কিছুটা সময় ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে যা কিছু জানতে পেরেছি তার সারমর্মই জানাচ্ছি আপনাদেরকে।
নব্বই দশকে খননের মাধ্যমে প্রাপ্ত বুদ্ধ মূর্তি, রাজা বলভট্টের মুদ্রা ও অন্যান্য নিদর্শনাদি পর্যালোচনা করে ধারনা করা হয় যে , বিহারটি খড়গ নৃপতিদের রাজত্ব্যকালে ৬ষ্ট শতাব্দীর শেষভাগে কিংবা ৭ম শতাব্দীর প্রথমভাগে নির্মিত হয়েছিল। সমগ্র বিহার চত্বরটি প্রাচীর ঘেরা এবং দেখতে অনেকটা ক্রুশাকৃতির ।
বিহারটির স্থাপত্যশৈলীতে ব্যতিক্রম নকশা পরিলক্ষিত হয় এবং তিন ধরনের নির্মাণশৈলী দেখা যায়। । স্থান স্বল্পতা ও বেশী সংখ্যক ঘরের সংখ্যা বৃদ্ধি করাই সম্ভবত এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। যদিও বাঙলার আর কোনো বিহারে এমনটি আগে দেখা যায় নাই। ঘরগুলোতে ও পিছনের দেওয়ালে কুলুঙ্গি ছিল। বিহারের যে সীমানা প্রাচীর ছিল সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ধ্বংস হয়ে যায়।
তাম্রলিপি, বৌদ্ধ শ্লোক উৎকীর্ণ বেশ কয়েকটি পিষ্টক, খড়গ নৃপতি বলভট্টের আমলেল ৫টি গুপ্ত অনুকরণের স্বর্ণ (খাদ মিশ্রিত) মুদ্রা, ৩টি হরিকেল রূপার মুদ্রা, ৪টি মিশ্রিত ধাতুর মুদ্রা, ধাতব মুদ্রার টুকরা, ২.৪৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট আদর্শ মানুষ পরিমাপের বেলেপাথর/স্থানীয় মেটেপাথরে ছেঁটেগড়া দন্ডায়মান বুদ্ধ মূর্তি, ১টি ধ্যানীবুদ্ধ অমিতাভ মূর্তি, ১টি ৮ হাত বিশিষ্ট তারা মূর্তি, ব্রোঞ্জ নির্মিত বিশাল ঘন্টা, ব্রোঞ্জের হাতল, পাথরের শিল নোড়া, লোহার পেরেক, পোড়া মাটির ফলক, নকশা করা ইট, গুপ্ত পরবর্তী কালের বড় আাকারের ১টি বুদ্ধ মূর্তি এখানে পাওয়া গেছে। কথিত আছে যে, এখানে নাকি সাত ঘড়া (কলশী) ব্রোঞ্জের তৈরী ছোট ছোট বজ্রাসনে বুদ্ধ ভট্টারক মূর্তিও পাওয়া গেছে। এই সব মূর্তির উপর বৌদ্ধ মতবাদ নাকি উৎকীর্ণ ছিল। পরবর্তীতে এর মাত্র ১৩টি মূর্তি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহ বিবেচনায় ধারনা করা যায় যে, বিহারটি শুরুতে মহাযানী ও পরবর্তীতে বোধিসত্ত্বযানসহ মাতৃতন্ত্রের প্রভাবে প্রভাবিত ছিল।
এই বিহারটি ইট ও কাঁদা-মাটির সংমিশ্রণে তৈরী করা হয়েছিল।মন্দিরের গায়ে বাংলার চিরায়ত লোকশিল্পের জীবনগাঁথা পোড়ামাটির ফলকচিত্রে দেখতে পাওয়া যায়।
Camera | iPhone 14 |
---|---|
Photographer | @sayeedasultana |
Location | Dhaka,Bangladesh |