কপিরাইট ফ্রী ইমেজ সোর্স : পিক্সাবে
ছোটবেলায় আমি বেশ দুরন্ত স্বভাবের ছিলাম । তাই অনেকগুলো রোমাঞ্চকর ঘটনা এবং দুর্ঘটনার সাক্ষী আমি । ছোটবেলায় আমার সাথে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু দুর্ঘটনার কথা ইতিমধ্যে আমি আমার বাংলা ব্লগে শেয়ার করেছি । দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - কুকুরের কামড় খাওয়া, হাত ভেঙে ফেলা, নৌকো উল্টে জলে পড়ে যাওয়া, গোরুর গুঁতো খাওয়া, ষাঁড়ের তাড়া খাওয়া, সাপের কবলে পড়া, গোসাপের তাড়া খাওয়া আরো কত কী । এর মধ্যে আজকে গোরুর গুঁতো খাওয়ার ঘটনাটি শেয়ার করছি আপনাদের সঙ্গে ।
তখন আমি গ্রামের স্কুলে ক্লাস থ্রী-তে পড়ি । শীতকালের দুপুর । স্কুলে ফাইনাল এক্সাম হয়ে গিয়েছে । স্কুলে তাই বেশ লম্বা ছুটি পড়ে গিয়েছে । শীতের দুপুরে ঘরে কোনোদিনই থাকতাম না । কারণ শীতের দুপুরে টো টো করে গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোর সেই মজা ।
সেদিনও যথারীতি পুকুরের ঠান্ডা জলে স্নান করে চাট্টি ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েছি গ্রামের আনাচে কানাচে টো টো করে ঘুরে বেড়াতে । বেলা একটু পড়লে খেলার মাঠে যাবো । গায়ে একটা পুরু টিশার্ট আর পরনে একটা হাফ প্যান্ট ছাড়া কোনো শীতের পোশাক নেই । ঠিক দুপুরবেলা যাকে বলে । মাথার উপরে সূর্য যথেষ্ঠ উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তাই একটুও শীত করছে না । তবে যখন মাঝে মধ্যে হু হু করে উত্তুরে হাওয়া বইছে তখন বেশ শীত শীত করছে ।
শীতের দুপুরে আমি সব সময় একা একাই ঘুরে বেড়াতাম । কখনো গ্রামের দক্ষিণে মাঠের দিকে, কখনো উত্তরের দিকে যে জঙ্গুলে জায়গাটা আছে যেখানে প্রচুর গাছগাছালি জট পাকিয়ে রয়েছে সেখানকার ঝোপে ঝাড়ে ঘুরে বেড়াতে দারুন লাগতো আমার । শীতের শুরুতেই আমাদের গ্রামের ধানক্ষেতে আর গাছগাছালি ঝোপ ঝাড়ে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটতো । পাখিদের কিচিরমিচির শুনতে আমার দারুন লাগতো । এই পাখিই ছিল আমার ঠা ঠা দুপুরে ঘুরে বেড়ানোর মূল আকর্ষণ । তবে আমি কখনো গুলতি বা এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করতাম না । পাখি দেখা আর তার ডাক শোনাই মুখ্য ছিল আমার কাছে ।
আর একটা গোপন উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য । তবে এখন আর বলতে দ্বিধা নেই । ছোটবেলায় ইটা সযত্নে গোপন রেখেছিলাম । আমার খুব ছবি আকার শখ জানেনই তো আপনারা । এই শখটা মাত্রারিক্ত ছিল একদম শৈশবে । তা গাঁয়ের ছেলে আমরা, রং পেন্সিল, রং-তুলি এসব কোথায় পাবো ? তাই আমাদের আঁকার সরঞ্জাম ছিল সাধারণ পেন্সিল, লাল-নীল-কলম কলম. কাঠ কয়লা, হাঁসের পালক এসব । রঙের জন্য আমরা ডিপেন্ড করতাম কাঠ কয়লা, খড়ি মাটি, চকের গুঁড়ো, পুঁইশাকের পাকা ফল, গাঁদা ফুলের পাঁপড়ি, জবা ফুলের পাঁপড়ি এসব । আর এই সব উপকরণ সংগ্রহের জন্যও আমি এমন টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম ।
শীতে প্রায় সবার বাড়ির আঙিনাতেই গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, জবা সহ নানান ফুল ফোটে । এই ফুল স্রেফ চুরি করে আনতুম আমি । যদি সেসময় আমার মা জানতে পারতো এই কথা তখন পিঠে পড়তো দুমদাম ।
যাই হোক এই ফুল চুরি করতে গিয়েই একদিন খেলুম গোরুর গুঁতো । সেই কথাই আজ বলবো । গ্রামের একটা বাড়ির পেছনদিকের একটুখানি জমিতে অনেকগুলো গাঁদা ফুলের গাছ ছিল সেটা আগের দিন ভালো করে দেখে এসেছিলাম । তার পরের দিন শুরু হলো আমার ফুল হরণের অভিযান । এই দিন পরিকল্পনা ছিল হাফ প্যান্টের তিনটে পকেট ভর্তি করে যত পারি গাঁদা ফুল ছিঁড়ে আনবো । তাই স্নানের পর বেছে বেছে যে প্যান্টের তিনটে পকেটই অক্ষুন্ন আছে সেটাই পরলাম । কারণ ছোটবেলায় প্রায়ই প্যান্টের পকেট ছিঁড়ে যেত আমার ।
এরপরে যথারীতি অভিযান । খাঁ খাঁ করা শীতের রোদ্দুরের দুপুরে বেরিয়ে পড়লুম ফুল চুরির মহৎ উদ্দেশ্যে । চারিদিক শুনশান । কেউ নেই কোথাও । থেকে থেকে শুধু একটা কি পাখি যেন টুউউউ টুউউউ করে ডাকছে । আর মাঝে মাঝে গা কাঁপিয়ে হু হু করে উত্তুরে হাওয়া বইছে ।
এমন সময় চুপিসাড়ে এসে দাঁড়ালাম ঘরের পেছনের গাঁদা ফুলের বাগানে । কেবলমাত্র একটা ফুলে হাত দিয়েছি এমন সময় পেছন দিকে ফোঁস ফোঁস করে কিসের শব্দ শুনে ঘাড় ঘোরাতে যাবো, তার আগেই হঠাৎ ফুল গাছ ফুঁড়ে একজোড়া শিং এসে সজোরে ঢুঁ মারলো আমার পেছনে । বোঁ করে সামনে কিছুটা এগিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লুম । ব্যথা খুব একটা বেশি লাগেনি । তার কারণ খুব সম্ভবতঃ গাঁদা ফুলের গাছগুলো । গুঁতোর অনেকটাই গাছগুলোর উপর দিয়ে গিয়েছে ।
যাই হোক মাটি থেকে উঠে দাঁড়ানোর আগেই গোরুটা আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে আবার গুঁতোতে এলো । ঠিক তখন, আমি খুব ছোট্ট এক বাচ্চা হওয়া সত্ত্বেও বুকে অসীম সাহস রেখে খপ করে ধরে ফেললুম গরুর শিং জোড়া । তখন আমার মাথার মধ্যে একটা জিনিসই শুধু একভাবে বেজে যাচ্ছে - "আশেপাশে কেউ নেই । চিৎকার করলেও কেউই আসবে না । তাই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা এখন নিজেকেও করতে হবে ।" ওইটুকু বয়সে ঐরকম চিন্তা আমি সেদিন কীভাবে করেছিলাম ভাবতেই অবাক লাগে এখন ।
ভয় না পেয়ে মাথা ঠান্ডা করে গোরুর শিং জোড়া খপ করে ধরে ফেলেই দিলাম সর্বশক্তি দিয়ে এক ঝাঁকুনি । ওই ঝাঁকুনিতেই কাজ হলো । গোরুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো । কয়েক সেকেন্ড মাত্র । এর পরেই শুনতে পেলুম "হাআআআম্বা ...." বলে একটা বাছুরের ডাক । সঙ্গে সঙ্গে গোরুটা এক ঝটকা দিয়ে আমার হাত থেকে শিং ছাড়িয়ে নিয়ে যেদিক থেকে বাছুরের ডাক এসেছে সেদিকে ছুটে গেলো ।
আর আমি সেখানে থাকি ? মাটি থেকে উঠে পড়ি মরি দিলাম ছুট । আমি কী আর জানতাম যে ওই বাড়ির গোরুর সদ্য বাচ্চা হয়েছে ? কখন জানি খোঁটা উপড়ে গোরুটা ছাড়া পেয়েছে আর এসে আমাকে দিয়েছে গুঁতিয়ে । সদ্য বাচ্চা হওয়া গোরু সাংঘাতিক গুঁতোনো হয় ।
Account QR Code
VOTE @bangla.witness as witness
OR