বনফুল কে নিয়ে আমার লেখা ছোট একটি গল্প - পর্ব ২

fxsajol -

চার বক্তব্য এবার দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিশদ করা যাক। বনফুলের জীবনাদর্শটিকে বোঝবার জন্য ‘মানুষ’ গল্পটি গ্রহণ করা যেতে পারে। গঙ্গাবক্ষে অস্তায়মান সূর্যের রশ্মিচ্ছটায় ভাবাবিষ্ট চোখে পৃথিবীটাকে একটি স্বপ্নলোক বলে মনে হয়। তৃণাঞ্চিত শ্যামল তীরে দেবালয়, রোমন্থনরত নধরদেহ গাভী, মুদিতনয়ন মার্জার, নহবতে পুরবীর আলাপ—সবকিছু মিলিয়ে কি সুন্দর এই পৃথিবী! কিন্তু বাস্তবতার আঘাতে এই স্বপ্নের ঘোর কাটলে জীবনের আরেকটি রূপ চোখে পড়ে। দেবালয়ের স্বর্গীয় পরিবেশের পাশেই কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত একটি লোক আর স্বাস্থ্যবতী এক যুবতী— ব্যাধি ও স্বাস্থ্য পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে—একই উদ্দেশ্যে। ক্ষুধার অন্ন চাই, ভিক্ষা তাদের ব্যবসায়। সে ব্যবসায়ে একজন মূলধন করেছে ব্যাধিটাকে, আরেকজন যৌবনকে। দেখা গেল মুদিতনয়ন মার্জারটি তপস্যায় রত ছিল না, ছিল ওৎ পেতে। ওটা তার ইঁদুর ধরার ছলমাত্র।

মাতৃস্তনাভিমুখী গোবৎসটিকে বঞ্চিত করে নধরদেহ গাভীর দুগ্ধ দোহন করছে মানুষ নিজের প্রয়োজনে। ইঁদুরের চিৎকারে আর গোবৎসের আকুতিতে সন্ধ্যাকাশের শান্তি বিঘ্নিত হল। কিন্তু ওটাও প্রকৃতির একদিক মাত্র। সদ্যমৃতবৎসা জননী অন্যের নবজাত সন্তানের কল্যাণ কামনা করছে। বহুবাধাসত্ত্বেও সতী মৃত-স্বামীর চিতায় পুড়ে মরছে, বহুবার বিফল হয়েও এভারেস্টে দুঃসাহসীর অভিযান বন্ধ হচ্ছে না। কিন্তু ওখানেও শেষ নয়, স্বার্থপর মানুষের কাছে ন্যায়- অন্যায়ের চেয়ে তার স্বার্থসিদ্ধিই বড়, তার সৌন্দর্য-চেতনাকেও ছাপিয়ে ওঠে তার সামান্যতম জৈবতৃপ্তি। তাই ছাদে উঠে জ্যোৎস্না পুলকিত রজনীর সৌন্দর্য উপভোগের আনুকূল্যের জন্য প্রয়োজন হয় সিগারেটের ধোঁয়ার নেশা। উদীয়মান চন্দ্রকে আকাশে রেখে সিগারেট কেনার জন্যে নেমে যেতে হয় গলির মোড়ে। এই আকাশ ও গলি, এই সুন্দর ও কুৎসিত, এই দুঃসাহসী মহৎ প্রেরণা ও আত্মরত প্রাণধারণের গ্লানি, –এরই নাম মানবজীবন, স্বর্গ ও নরককে একই সঙ্গে বুকে ধরে এই যে নিত্যপ্রকাশমানা প্রকৃতি—এরই নাম মানুষের পৃথিবী। এই পৃথিবীতে যাকে বনফুল মানুষের নিয়তি বলতে চান, এবার তার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। এ প্রসঙ্গে 'হাসির গল্প' নামক রচনাটিকে প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। হাসির গল্প’এ নায়ক হরিহরের জীবনটিতে করুণ রস যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে। নিজের অসুস্থ অসুন্দর দেহটি ব্যাধিজর্জর, পাশেই একটি মেয়ে রোগশয্যায় শায়িত, বারান্দায় আর একটি শিশু ক্রন্দনরত, গৃহিণী রণচণ্ডী, দ্বারে পাওনাদার-মুদির অশ্রাব্য কটূক্তি। এই পরিবেশে হাতলভাঙা